তালপাতার সেপাইয়ের বাবা
প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়
১
কমলকে কেউ কখনো গলা তুলে কথা বলতে শোনেনি, এমনকি বউয়ের সামনেও নয়। কমলের মা এ নিয়ে প্রায়ই দুঃখ করেন। বিশেষত বৌমা মুখ থেকে কথা পড়া মাত্র পান সেজে না দিলে তিনি ছেলেকে শুনিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন “কপাল! ছেলে কড়া না হলে বৌমা তো অবাধ্য হবেই। প্রথম রাতেই বেড়াল না মারলে…”
একমাত্র মেয়ে বৈশাখীকে বকতে পারে না বলে স্ত্রী মিনতিও একসময় বিরক্ত হয়ে বলত “পুরুষ মানুষ এত মিনমিনে হলে সংসার চলে? কী করে যে অফিস কাছারি করো, কে জানে বাবা!” পুরুষটি আত্মপক্ষ সমর্থনে অনেক কিছু বলবে মনে করে মুখ খুলত। কিন্তু স্রেফ তোতলানো ছাড়া কিছুই করে উঠতে পারত না। ইদানীং অবশ্য এই সমস্যা মিটেছে। মেয়ের ব্যাপারে মিনতি ওরকম বললেই কমল মুচকি হেসে শুনিয়ে দেয় “চেঁচামেচি করলেই ছেলেমেয়ে মানুষ হয়? পাড়ায় তো এত মিলিটারি বাবা আছে। কার মেয়ে মান্তুর মত রেজাল্ট করেছে? মাধ্যমিকে স্কুলে ফার্স্ট, উচ্চমাধ্যমিকে জেলায় ফার্স্ট। এবার দেখবে ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট হবে…”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। সবে একটা সেমিস্টারে ফার্স্ট হল, এখনই নজর দিয়ে সর্বনাশ করো আর কি…” বলে মিনতি আলোচনায় দাঁড়ি টেনে দেয়।
গিন্নী আর মায়ের অভিযোগগুলোকে কমল বিশেষ পাত্তা দেয় না। সংকট অন্যত্র। আসলে সে নিজেই নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত নিরীহ মনে করে। কে কী ভাবল তা নিয়ে মাথা ব্যথা না থাকলেও নিজের কাছেই লজ্জিত হয়ে থাকে এই ভেবে যে ছেলে এরকম তৈরি হয়েছে জানলে বাবা খুশি হতেন না। কিন্তু কী করা যাবে? কমল যে তার বাবার কিছুই পায়নি। না চেহারায়, না স্বভাবে — কোথাও বাবার সাথে তার মিল নেই।
বাবা অমলেন্দু ছিলেন ছ ফুট এক ইঞ্চি, ছেলে কমলেন্দু পাঁচ ফুট তিন। বাবা ছিলেন ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, কমল মায়ের কাঁচা সোনার মত রংটা পেয়েছে। বাবা গান গাইলে কি আবৃত্তি করলে পাশের বাড়ি থেকে শোনা যেত, আর যে শুনত সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। কমলের গলার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে ওর অভাব বোধ ওসব নিয়ে তত নয়। আসলে বাবা ছিলেন লড়াকু শ্রমিক নেতা, জেল খেটেছেন। এলাকার অধুনা বন্ধ কারখানার পুরনো শ্রমিকদের চোখের পাতা এখনো তাঁর নাম শুনলে ভিজে আসে। আর কমল? কলেজে পড়তে ছাত্র ইউনিয়নের দু টাকা চাঁদার সদস্য হয়েছিল, কর্মজীবনে ব্যাঙ্ক কর্মচারী ইউনিয়নেরও সদস্য ছিল। তবে মিছিলে একজন গলা তুলে “শোষকের কালো হাত” বললে যারা গলা মিলিয়ে “ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও” বলে তাদের দলে আর কি।
নেতা হতে পারেনি বলে কিন্তু কমলের দুঃখ নেই। সে বিলক্ষণ বোঝে সকলের নেতা হওয়ার কথা নয়। বাবার মুখে ছোট থেকে শুনেছে “নেতা হওয়ার জন্যে পার্টি করে ধান্দাবাজরা।” কমলের দুঃখ এই যে সে ভীতু — লোকে যাকে সাবধানী বলে। কেবলই ভাবে এমনটা কেন হল? শুধু যে বাবা অমন ছিলেন তা তো নয়, কমলের দাদামশাই স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। শয্যাশায়ী দিদিমা, যিনি গত জুলাইয়ে ১০১ এ পড়লেন, মাঝে মধ্যেই বলেন “তুই ঘরে বইস্যা পচতাছস ক্যান? পাড়ার অ্যাতগুলান লোক জেলে গেল, তুই যাইতে পারস না?” দিদিমার যে মাথার ঠিক নেই, অতীত বর্তমান দুবেলা গুলিয়ে যায় সেকথা দুনিয়াসুদ্ধ লোকের মত কমলও জানে। তবু কথাগুলো তার গায়ে বেঁধে, মনে হয় দিদিমা সব জেনে শুনেই বলছেন।
অথচ কমলের জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটা দিদিমা কোন ভাবে জেনে গেছেন এমন হতেই পারে না, কারণ সে কথা আত্মীয়স্বজন কোনদিন জানতে পারেনি, সহকর্মীরা জানে না, মিনতি পর্যন্ত জানে না। এমনকি বৈশাখী ওরফে মান্তু, যাকে ছোট থেকে অনেক গুরু গম্ভীর কথা কমল একান্তে বলে, আর কাউকে বলতে পারে না বলেই বলে, তাকেও কখনো বলেনি। তাহলে দিদিমা জানবেন কী করে? কিন্তু অপরাধবোধ যুক্তি মেনে চলে না। অভিজ্ঞ হত্যাকারীও অনেক সময় স্রেফ অপরাধবোধের ঠেলায় ধরা পড়ে যায়। যে প্রমাণ আদৌ নেই তা লোপাট করার চেষ্টায় খুনের জায়গার আশেপাশে ঘুরঘুর করে এবং ধরা পড়ে। কমল তো নেহাত ভদ্রলোক।
ঘটনাটা ঘটেছিল কলেজজীবনে। এক অধ্যাপক কমলের ব্যাচেরই এক ছাত্রীর সাথে কিসব অসভ্যতা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। প্রিন্সিপালও বদ লোক। অভিযোগ ঠিক করে শুনতেই চাইলেন না। তাই ঠিক হল অধ্যাপকের শাস্তি না হওয়া অব্দি কেউ ক্লাস করবে না। কয়েকদিন অচলাবস্থা চলল, তারপর কর্তৃপক্ষ ক্লাসে না গেলে কলেজ থেকে বার করে দেওয়ার হুমকি দিলেন। তাতেও পাঁচ ছ জনের বেশি ক্লাসে গেল না। কাগজে খবর বেরোতে শুরু করল। বেগতিক দেখে অধ্যাপক অধ্যাপিকারা ভাল ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করে ডেকে নরমে গরমে বোঝাতে লাগলেন।
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের হেড কমলদের চার পাঁচজনকে ডেকে বললেন “ফিলোজফির ক্লাসে কী হয়েছে তা নিয়ে তোমরা নিজেদের লেখাপড়ার ক্ষতি করছ কেন? ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছে তোমরা কেউ জানো? তোমরা ছিলে সেখানে?”
সবাই চুপ। কেউ ছিল না বটে।
“এসব নোংরা পলিটিক্স। এর মধ্যে জড়িয়ে নিজেদের কেরিয়ারের বারোটা বাজিও না। বন্ধুদেরও বোঝাও। প্রিন্সিপাল মানুষ ভাল, তাই হুমকি দিলেও এখনো কিছু করেননি। এরপর কিন্তু সত্যি সত্যি যারা ক্লাসে ফিরবে না তাদের রাস্টিকেট করে দেওয়া হবে।”
সকলের মাথা নীচু, হাড়ে ঠকঠকানি। একটি মেয়ে কেবল বলল “স্যার, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? কাগজে কিন্তু বেরিয়ে গেছে সব। আমাদের উপর চাপ দিলে কিন্তু পলিটিকাল প্রেশার আসবে।”
স্যার চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন, শুনিয়ে দিলেন এম এল এ, এম পি সবাই তাঁর বন্ধু। অথরিটিকে কেউ কিস্যু করতে পারবে না। তারপর হঠাৎ কমলের দিকে ফিরে “তুমি তো সেই মফস্বল থেকে আসো, কষ্ট করে লেখাপড়া করছ। কোথায় ভাল চাকরি বাকরি পেয়ে সংসারটা সামলাবে, তা নয়, দলে ভিড়েছ। এখান থেকে তাড়িয়ে দিলে কোন কলেজ ভর্তি নেবে না তা জানো? যাও। কাল থেকে ক্লাসে আসবে।”
সুড়সুড় করে চলে আসা হয়েছিল। পরদিন দোনা মোনা করে কলেজে পৌঁছে দেখা গেল বাইরে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ধরনায় বসে স্লোগান দিলেও অনেকেই ক্লাস করছে। কমলও সুবোধ বালক বালিকাদের দলে যোগ দিল। দু এক দিনের মধ্যে জানা গেল অভিযুক্ত অধ্যাপক নাকি ক্ষমা চেয়েছেন। তাই কলেজ স্বাভাবিক হয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে দেখা হয়নি কাউকে সত্যি তাড়ানো হয়েছিল কিনা। তবে কিছুদিন পর জানা গেল সেই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। কেউ কেউ বলল “কী করবে? প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিল তো।”
সেদিনই কমল বুঝে গেল সে বাবার অযোগ্য সন্তান। পুলিশের লাঠি খাওয়া, জেলে যাওয়া দূর অস্ত, সামান্য ক্লাস বয়কট করার সাহসও তার নেই। তখন খবরের চ্যানেল ছিল না, কাগজগুলোও কলেজে ঝামেলা মিটতেই কেন কে জানে সব ভুলে গেল। তাই মেয়েটার মৃত্যু নিয়ে আর জল ঘোলা হয়নি। সেই কারণেই হয়ত বাবার গোচরে আসেনি ছেলের কলেজের গণ্ডগোলটা। তিনি তখন ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। কমলের আজও ধারণা ঘুণাক্ষরে জানতে পারলে বাড়ি থেকে বার করে দিতেন।
বাবা যখন মারা গেলেন, মিনতি তখন অন্তঃসত্ত্বা। এমনিতে জন্মান্তরে বিশ্বাস করে না, কিন্তু সেই সময় কেন কে জানে কমলের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল বাবা ফিরে আসবেন ছেলে হয়ে। আর সেই ছেলে যোগ্য বংশধর হবে। অর্থাৎ কমলের মত হবে না, তার বাবার মত হবে। ফলে বৈশাখীর জন্মের পর সে বেশ মুষড়ে পড়েছিল। এখন মেয়েকে নিয়ে দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না দেখে গিন্নী যে সেসব দিনের কথা মনে করে আড়ালে হাসে, সেকথা কমল জানে না। অবশ্য মিনতিও টের পায় না যে মেয়ের লেখাপড়া নিয়ে যতই গর্ব হোক, কমল আজও মাঝে মাঝে ভাবে “নাঃ, বাবার মত হল না।”
দেশের যা অবস্থা, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেরকম মারপিট চলে তাতে সারাক্ষণ চিন্তা হয়। ছেলে হলে তাও কথা ছিল, মেয়েকে তো কোন মতেই রাজনীতি করতে উৎসাহ দেওয়া যায় না। তাই বাক্স প্যাঁটরা বেঁধে বৈশাখীকে রওনা করে দেওয়ার সময়ে মিনতি যখন বলল “লেখাপড়া করতে যাচ্ছ, মন দিয়ে তা-ই করবে। পার্টি ফার্টি করতে যেয়ো না বাপু,” তখন কথাটা কানে লাগলেও নির্বিবাদী কমল চুপ করে থেকেছে।
কদিন হল বড় চিন্তায় পড়েছে, কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। অফিসে খুব বেশি বন্ধু ছিল না কোনদিন। যে দু একজন ছিল তারাও অবসর নিয়ে ফেলেছে। কমলের নিজেরই তো আর বছর দুয়েক চাকরি বাকি। হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে কি আর ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তার কথা আলোচনা করা যায়? মিনতির যে ওসব চিন্তা নেই তা-ও কমল জানে। ও বোধহয় জানতেই পারেনি দেশে কী ধুন্ধুমার চলছে। কী করেই বা জানবে? সন্ধে ছটা থেকে সাড়ে নটা দশটা অব্দি তো মেগা সিরিয়াল নিয়েই কাটায়। খবরের ক্ষিদে মেটাতে কমল মোবাইলের শরণ নিয়েছে। তাই প্রতি মুহূর্তে কোথায় কী হচ্ছে সব তার নখদর্পণে।
জানতে পারে আর শিউরে ওঠে। কখনো ভয়ে, কখনো রোমাঞ্চে। উফ! কি সাহস আজকাল ছাত্রছাত্রীদের! বিশেষ করে মেয়েদের। এক দল পুলিশের দিকে গোলাপ এগিয়ে দিচ্ছে বৈশাখীর বয়সী একটা মেয়ে! আরো ভয়ঙ্কর — হেলমেট পরা এক বদের হাঁড়ি গুন্ডার সাথে মিলে কয়েকটা পুলিশ একলা ছেলেকে পেটাচ্ছিল। তাকে এসে ধরল দুটো মেয়ে! আবার আঙুল উঁচিয়ে পুলিশকে ধমকেও দিল! মোবাইলে এমন শয়ে শয়ে ছবি, ভিডিও একের পর এক আছড়ে পড়ে আর কমল ভাবে “এরা কোথা থেকে পায় এত সাহস? আমি তো পারতাম না।”
সেই সঙ্গে ভয় হয়। যতই সাহস থাক, এই ছেলেমেয়েগুলো আসলে তো ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দার। পুলিশ প্রশাসনের তো মায়া দয়া নেই। যদি ভাবে একেবারে শেষ করে দেবে! বৈশাখীর ইউনিভার্সিটির ছেলেপুলেও মিটিং মিছিল করছে। তবে তারা এখনো পুলিশ, গুন্ডার নেকনজরে পড়েনি। যদি পড়ে? অবশ্য বৈশাখী বাড়িতে যতই দস্যিপনা করুক, অন্য শহরে পড়তে গিয়ে মায়ের কথা রেখেছে। রাজনীতিতে জড়ায়নি। কমলের অবশ্য সন্দেহ হয়েছিল মেয়ে বাবা-মাকে টুপি পরাচ্ছে। তাই সে ওদের ইউনিভার্সিটির খবর দেখতে পেলে সর্বদা খুঁটিয়ে পড়ে, কোন ভিডিও পাওয়া গেলে বারবার দ্যাখে। এখন অব্দি কোথাও বৈশাখীর নাম গন্ধ পাওয়া যায়নি। তা বলে নিশ্চিন্ত থাকা যায় নাকি? ওদের ইউনিভার্সিটিতে কিছু ঘটলে মেয়ের গায়ে আঁচ লাগবে না তা তো হয় না। তাছাড়া গোলমালে যদি ইউনিভার্সিটি বন্ধই হয়ে যায়?
এসব ভাবনায় আজকাল রাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে প্রায়ই। কমল বারবার উঠছে, বাথরুমে যাচ্ছে। মিনতির ঘুম এমনিই পাতলা। সে ভাবগতিক দেখে কেবলই বলছে “তুমি ডাক্তার দেখাও। নির্ঘাত প্রস্টেটের সমস্যা হচ্ছে।” ডাক্তারের বোন নিজেকেও ডাক্তার ভেবে গেল সারা জীবন।
কমল খুবই বিরক্ত হয়, কিন্তু কী আর বলবে? সে নিশ্চিত জানে আসল কথাটা বললে গিন্নী এখনই লাফালাফি শুরু করবে ঘরের মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে এনে কোন এলেবেলে কলেজে ভর্তি করানোর দাবীতে। কমল তো আর ধমকে চুপ করাতে জানে না।
২
যা ভয় পাচ্ছিল, তা-ই হল। সত্যি কথা বলতে, কমল যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশিই হল। তখন অফিস ফেরত ট্রেনে সবে একটু ঝিমুনি এসেছে, মিনতি ফোন করে কান্নাকাটি করল। টিভিতে দেখাচ্ছে বৈশাখীর ইউনিভার্সিটিতে গুন্ডারা ঢুকে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এদিকে মেয়ের মোবাইলে মা বার দশেক ফোন করে ফেলেছে, কেবল রিং হয়ে যাচ্ছে।
“ঐ যে কী একটা পাঞ্জাবি মেয়ে মান্তুর বন্ধু? যশপ্রীত না গুরপ্রীত? ওকে ফোন করো না…”
“আরে আমি কি তোমার ভরসায় বসে আছি?” মিনতি ঝাঁঝিয়ে উঠল। “ওর যত বন্ধু সকলকে ফোন করা হয়ে গেছে। কেউ তুলছে না। হায় ভগবান, কী যে করি!”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও। অধৈর্য হয়ো না। আমি দেখছি,” বলে কোন মতে কমল ফোনটা রেখে দিল। কিন্তু কী দেখবে, কার কাছে খোঁজ নেবে, কিছুই ভেবে উঠতে পারল না। ফোনে ফেসবুক খুলে দেখল প্রচুর পোস্ট এসে গেছে মেয়ের ইউনিভার্সিটির ব্যাপারে। গিন্নী একটুও বাড়িয়ে বলেনি, ব্যাপারটা সত্যিই সাংঘাতিক। গুন্ডারা মেয়েদের গায়েও হাত তুলেছে; মাস্টারমশাই, দিদিমণিদেরও ছাড়েনি। কমলের হাত পা কাঁপতে শুরু করে, বুঝতে পারে ঘাম গড়াচ্ছে কপাল বেয়ে।
“কী হল, কাকু? শরীর খারাপ লাগছে?” একটি অল্পবয়সী ছেলে, মুখ চেনা, রোজ এই ট্রেনেই ফেরে, জিজ্ঞেস করে।
“আপনি যতই মাথা নাড়ুন, এতগুলো লোকের গরম লাগছে না, আপনি দরদরিয়ে ঘামছেন। প্রেশার হাই আছে?”
“হ্যাঁ… ঐ… ওষুধ খাই…”
“ব্যাস ব্যাস, আর বলতে হবে না। এই যে দাদা, জানলার সিটটা ছেড়ে দিন তো একটু।”
ছেলেটা দায়িত্ব নিয়ে জানলার পাশে বসিয়ে দেয় কমলকে। এক ভদ্রমহিলা জলের বোতল এগিয়ে দেন।
উপকারী ছেলেটি বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কমলের মনে হল বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, নিজেকে সামলে নেওয়া উচিৎ। স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে এত দুশ্চিন্তা করার কোন মানে হয় না। বৈশাখীর যে কিছু হয়েছে এমন কোন প্রমাণ তো পাওয়া যায়নি। যা চলছে ওখানে, তাতে ওরা ফোন ধরবে না এটাই তো স্বাভাবিক। হয়ত কোথাও লুকিয়ে আছে। এমনও তো হতে পারে বৈশাখী ক্যাম্পাসে নেই এই মুহূর্তে। হয়ত বন্ধুবান্ধবদের সাথে কোথাও বেরিয়েছে, যখন ফিরবে ততক্ষণে মারপিট থেমে যাবে। নিজের বুদ্ধিকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে এরকম নানা কল্পনা করতে করতে বৈশাখীর বাবা স্টেশন থেকে রিকশায় উঠল।
পাড়ার রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল “দাদার কি শরীলডা খারাপ, না সাইকেল নিয়া বেরান নাই?”
“না না, আজকে একটু ক্লান্ত লাগছে আর কি। সাইকেলটা থাক, সকালে বাজার করতে এসে নিয়ে নেব,” অপ্রস্তুত কমল উত্তর দিল।
বাড়ি পৌঁছাতেই মিনতির ধমক।
“এ কি! রিকশায়! শরীর খারাপ লাগছে?… উফ! তোমাকে কিচ্ছু বলার উপায় নেই… এত টেনশন করো কেন? এত দূর থেকে টেনশন করে কী হবে?… আমি প্রণতিকে বলেছি খবর নিতে… এখন গেলে তো ঢুকতে পারবে না, পুলিশ কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না… একটু ঠান্ডা হলেই বাবুয়া যাবে ওখানে… তুমি চুপ করে বসো এক জায়গায়।”
বলতে বলতে টিভিটা বন্ধ করে দিল মিনতি। কমল খেয়াল করতে পারল না শেষ কবে ভর সন্ধেবেলা বাড়ির টিভিতে খবরের চ্যানেল চলতে দেখেছে।
“ওটা বন্ধ কোরো না…”
“এখন খবরদার টিভি দেখবে না। নতুন কিচ্ছু দেখাচ্ছে না। গুন্ডারা একটু আগে পুলিশের সামনে দিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি চলে গেছে। সেই দু আড়াই ঘন্টা আগেকার ছবিই বারবার দেখাচ্ছে এখন।”
কিছু বুঝে ওঠার আগেই পকেট থেকে ফোনটাও তুলে নিল।
“কী হচ্ছে কি এটা!”
“চুপ। বাথরুমে যাও, ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে থাকো খানিকক্ষণ…”
“হ্যাঁ, আমার তো এখন শুয়ে থাকারই কথা। আমার মেয়ের কোন খোঁজ নেই, আমি এখন শুয়ে থাকব। কখন তোমার বোনের ছেলে ওদের ক্যাম্পাসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানাবে, সেই ভরসায় আমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব।”
শান্তশিষ্ট কমল গজ গজ করল, বিশেষ পাত্তা পেল না। অগত্যা গিন্নীর আদেশগুলোই পরপর পালন করল। মাথাটা একটু ঠান্ডা হতে বুঝতে পারল যে মানুষ আধ ঘন্টা আগেই ফোনে কান্নাকাটি করছিল, তার এখন এত নিশ্চিন্ত হয়ে যাওয়ার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
গিন্নীকে এক্ষুণি জিজ্ঞেস করলে যে কোন উত্তর পাওয়া যাবে না তাও বুঝল। ছাব্বিশ বছর ঘর করছে, ফলে কমলের ধারণা সে মিনতিকে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত চেনে। এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে মিনতি চা করে না ডাকা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে শুয়ে থাকতে পারত না, চায়ে চুমুক দিয়েও বৈশাখীর মা কখন নিজে থেকেই মেয়ের ব্যাপারে কিছু বলবে তার অপেক্ষাতেও থাকতে পারত না।
“ধীরে সুস্থে খেয়ে নাও, তারপর কম্পিউটারটা চালাও,” মিনতি বলল।
“কেন?”
“প্লেনের টিকিট কাটো। মেয়ের কাছে যেতে হবে।”
উত্তেজনায়, উদ্বেগে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে আবার গিন্নীর ধমক খেল কমল। জানতে পারল বৈশাখীর এক বন্ধু ফোন করেছিল তার মাকে। গুন্ডাদের লাঠির ঘায়ে আরো অনেকের সাথে বৈশাখীরও মাথা ফেটেছে। বন্ধুটির বক্তব্য ওরা সামলে নেবে। কিন্তু মিনতি জানিয়ে দিয়েছে সে মেয়ের কাছে যাবেই।
৩
কিছুতেই পরের দিনের টিকিট পাওয়া গেল না। অগত্যা একদিন পরে কমল আর মিনতি মেয়ের হাসপাতালে পৌঁছল। হাসপাতালের বাইরে একগাদা ছেলেমেয়ের ভিড়। মিনতি হাসপাতালে না ঢুকে সেই ভিড়কেই জিজ্ঞেস করল “বৈশাখী বিশ্বাস কত নম্বর বেডে ভর্তি?” গিন্নীর এই অপ্রয়োজনীয় লোকের সাথে কথা বলার অভ্যাসটার মনে মনে সমালোচনা করতে গিয়ে কমল হোঁচট খেল। কারণ দেখা গেল একাধিক ছেলেমেয়ে মিনতির সাথে খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে। সকলেই সকলের আগে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বৈশাখীকে কোন দিকে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে। ওরই মধ্যে একটা মেয়ে, যাকে প্রথমে কমল ছেলে বলে ভেবেছিল, মিনতির হাতটা এমনভাবে ধরল যেন অনেক কালের পুরনো বন্ধু। তারপর মিষ্টি হেসে “প্লিজ কাম উইথ মি” বলে হাসপাতালে ঢুকল।
হাঁটছে না তো, দৌড়চ্ছে। ওর পিছনে দৌড়তে দৌড়তে কমল মিনতিকে জিজ্ঞেস করল “এ কি সেই কানওয়ালপ্রীত? তোমার চেনা?”
“নামটা গুরপ্রীত। এ সে নয়। আমার চেনাও নয়। তোমার মেয়ের চেনা।”
“এই ধাড়ি মেয়েটা মান্তুর ক্লাসে পড়ে!” কমল যতটা সম্ভব গলা নামিয়ে বলল।
“আঃ! ওর ক্লাসে পড়বে কেন? এ পি এইচ ডি স্টুডেন্ট।”
এত বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি স্টুডেন্টের সাথে বি এ সেকেন্ড ইয়ারের বৈশাখীর কী করে আলাপ হওয়া সম্ভব সেটা বুঝে ওঠার আগেই কমল দেখল সে মেয়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। মান্তুকে ঘিরে বসে আছে গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ে। বোঝাই যাচ্ছে ওর বন্ধুবান্ধব। গোটা ওয়ার্ডে সবার একজন বা দুজন ভিজিটর, এদিকে মান্তুর বেড ঘিরে এরা মাছের বাজার বসিয়ে ফেলেছে। যে কোন সময় কোন ডাক্তার কি নার্স এসে ধমক দেবে।
মান্তুর মাথায় ব্যান্ডেজ, ডান হাতে প্লাস্টার, বাঁ পায়ে প্লাস্টার। কমলের বুক কেঁপে উঠল। মেয়েটা ছোট থেকেই ভীষণ রোগা। দুরন্তপনার অন্ত নেই, অথচ ফুঁ দিলে পড়ে যাবে এমন রোগা। কত অ্যালোপ্যাথি কত হোমিওপ্যাথি করানো হল, কিছুতেই কিছু হল না। সঙ্গতি থাকায় রোজ টেংরির জুস খাওয়ানো হয়েছে এক সময়, মেয়ে সেই তালপাতার সেপাই রয়ে গেল। এই দুর্বল মেয়েটাকে এইভাবে মেরেছে! বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই এদের?
মান্তু এমন হাসাহাসি করছিল, কে বলবে মাথা ফাটা, হাত-পা ভাঙা? বন্ধুরা উঠে দাঁড়িয়ে তার বাবা-মাকে বসতে দিল। মেয়ে মুখ দেখেই বুঝল বাবা ভীষণ ভয় পেয়েছে। তাই কামানো গালে হাত বুলিয়ে বলল “ও বাবা, ঘাবড়াচ্ছ কেন? কিচ্ছু হয়নি। কালকে একটু মাথাটা ঘোরাচ্ছিল, তাই হসপিটাল থেকে ছাড়েনি। স্ক্যান ফ্যান করে দেখে নিয়েছে, সব ঠিক আছে। চলে যাব আজকেই।”
কমল ঘাবড়ায়নি এরকম দেখানোর চেষ্টা করল। সে এত বোকা লোক নয় যে আয়না নেই বলে বুঝবে না চেষ্টাটা কী হাস্যকর হল, তাই লজ্জা পেল। তার অবস্থা দেখে মান্তুর বন্ধুরা ফিক ফিক করে হাসল। ওদের সাথে বাবা-মায়ের একে একে আলাপ করাল মেয়ে। মিনতি বেশ স্বাভাবিক, কিন্তু কমলের কানে কিছুই ঢুকল না। সে কেবল ভাবছে, বেছে বেছে তার মেয়েকেই এভাবে মারা হল কেন? অবশ্য কাগজে টিভিতে আরো অনেক বীভৎস মারের ছবি সে দেখেছে। কিন্তু বৈশাখী তো আর তাদের মত লড়াকু কেউ নয়। শেষমেশ সে প্রশ্নটা করেই ফেলল।
“কেয়া বাত করতে হ্যাঁয়, আঙ্কল? ভ্যায়শাখি কো নহি মারেগা তো কিসকো মারেগা?” বিশ্ব বখাটে চেহারার ছেলেটা এক গাল হেসে বলল। “আপ কি বেটি লিডার হ্যায়। লোগোঁ কো ডরানে কে লিয়ে লিডার কো হি মারনা পড়তা হ্যায় না?”
কমল একেবারে হাঁ হয়ে গেল। মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল ও ছোটবেলায় কমলের চশমা লুকিয়ে রেখে যেমন চোর চোর হাসত, ঠিক তেমনি হাসছে৷ মিনতিকে জিজ্ঞেস করতে যাবে সে জানত কিনা, ও নিজেই মুখ টিপে হেসে বলল “আমি পইপই করে বারণ করেছিলাম। আমার কথা শোনে নাকি? তুমিই তো আদর দিয়ে মাথায় তুলেছ। এখন ঠেলা সামলাও।”
কমলের মনে হল তার বুকের ভিতর কেউ হাতুড়ি পিটছে। বৈশাখীর বন্ধুদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল “লিডার? হোয়াট কাইন্ড অফ লিডার?”
ওদের একজন বলল “শি ইজ এ জি এস অফ আর্টস ফ্যাকাল্টি।”
আর যে মেয়েটি পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল, সে বলল “ডোন্ট ওয়ন্ট টু মেক হার কমপ্লেসেন্ট, বাট শি ইজ আ ব্রাইট প্রসপেক্ট। আওয়ার সিনিয়র লিডারস আর কিপিং অ্যান আই অন হার।”
এবার কমল লাফিয়ে উঠেই পড়ল। তারপর স্থান কাল পাত্র কিচ্ছু জ্ঞান না করে মেয়েকে একেবারে ছোটবেলার মত জড়িয়ে ধরে দু গালে চুমু খেল। মিনতি আঁতকে উঠে ভাবল এই বুঝি প্লাস্টার সুদ্ধ কোলেই তুলে নেবে মেয়েটাকে। মেয়ের বন্ধুরা হেসে খুন৷ গর্বিত পিতা সেসব গ্রাহ্য না করে তাদের জিজ্ঞেস করল “তো তুম লোগ ডরে কেয়া?”
তারা সমস্বরে বলল “নেভার, নেভার।”
বৈশাখী বলল “আরে আমি ভয় পেলে তবে তো ওরা ভয় পাবে।”
“তবে? অমল বিশ্বাসের নাতনিকে নাকি মেরে ভয় পাওয়াবে। জম্মে হবে না।” মিনতি মনে করে দেখল স্বামীকে কোনদিন এত উচ্চগ্রামে কথা বলতে সে শোনেনি।