Meghmukti Patrika

মেঘমুক্তি পত্রিকা | Powered by Hashtag Kolkata Bengali e Magazine

Essay

প্রাথমিক শিক্ষা কোন ভাষায় হওয়া উচিৎ

অসীম  নাথ

আমরা অনেকেই ছোটবেলা থেকে ইংরেজি ভাষায় পড়াশুনো করেছি এবং মনে-মনে একটা গর্বও অনুভব করেছি। আমাদের অভিভাবকেরা, অনেককষ্ট এবং খরচা সাপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করিয়েছে এবং আমরা তাদের স্বপ্ন সফল করতে চেষ্টা করেছি এবং হয়তো খানিকটা করেওছি। তাদের স্বপ্ন ছিল এই যে আমরা যেন ইংরেজি পড়তে বা বলতে গিয়ে আটকে না যাই, যে সুযোগ তারা নিজেদের ছাত্রাবস্থায় পায়নি এবং যার ফলে তাদের নানা রকম সমস্যার সম্মুখহীন হতে হয়েছে, আমাদের ক্ষেত্রে যেন তা না হয়। এই ব্যাপারে আমরা সত্যিই ভাগ্যবান। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, ‘কেন’? আমরা স্বাধীন ভারতে জন্মেছি, তারই একটা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে বাংলায় শিক্ষা লাভ করেছি এবং আগামী দিনে এখানেই হয়তো কিছু একটা করার চেষ্টা করবো, তাহলে ইংরেজির মত একটা বিদেশী ভাষা শেখার কি এমন প্রয়োজন পড়ে গেল? এর উত্তরের আশায় একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক।

          ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়, অখণ্ড ভারতের শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। কিন্তু কর্তারা যাদের শাসন করছে, তাদের সাথে ভাল করে কথা বলতে বা তাদের কথা বুঝতে বিস্তর অসুবিধার সম্মুখীন হতে  হচ্ছে । তার থেকেও বড় মুশকিল এই যে প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কাজকর্ম সামলাতে যে সব ভারতীয়দের কেরানি রূপে নিয়োগ করা হচ্ছে তারাও এই ইংরেজি ভাষার কিছুই বোঝেনা। ফলে ১৮৩৫ সালে, থমাস ব্যাবিংটন ম্যাকাউলের উপদেশে এবং তৎকালীন তথা ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপাল (গভর্নর-জেনারেল) লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর আদেশে ‘ইংলিশ এডুকেশন এক্ট, ১৮৩৫’ স্থাপিত হল, যার ফলে এ দেশেও ইংরেজি শিক্ষার প্রসার শুরু হল। তা সে নয় ইংরেজদের শাসনকাল, তারা তো চাইবেই তাদের ভাষার প্রসার হোক এবং সব কাজকর্ম সেই ভাষাতেই হোক। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও ইংরেজি ভাষার এত প্রভাব কেন? না সরকার যে চাইনি তা নয়, ১৯৫০ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল যে দেবনাগরী হরফে হিন্দি ভাষাই হচ্ছে ভারতের সরকারী ভাষা, কিন্তু তখন বিভিন্ন দক্ষিনী এবং উত্তর-পূর্বীয় রাজ্যগুলির প্রতিবাদে, অবশ্য পশ্চিমবঙ্গও তার মধ্যে একটি, ১৯৬৫ সালে আবার ইংরেজিকেই সরকারী ভাষা হিসেবে মনোনীত করা হয় (অফিশিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ এক্ট, ১৯৬৩ ও ১৯৬৭) ।

এইবার দেখতে হবে যে সরকারী ভাষা ঘোষিত হবার পরেও, আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ভাষার ওপর এত কম দখল বা ভাষান্তরে, ভীতি কেন? আমাদের রাজ্যে প্রাথমিকভাবে দু’ধরনের সরকারী স্কুল আছে, বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি মাধ্যম। এর মধ্যে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলিতেই সমস্যা সব থেকে বেশী। যদিও ইংরেজি শিক্ষাকে এখন আবশ্যিক করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ১৯৮২ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের একটি হঠকারী সিদ্ধান্তে প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়ান বন্ধ হয়েছিল এবং ২২ বছর বাদে, ২০০৪ সালে সেই সরকারই, চাপে পড়ে এবং তার ভুল বুঝতে পেরে, আবার পড়ান চালু করেছিল। কিন্তু এই ২২ বছরে যে সব ছাত্রছাত্রীরা বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়াশোনা করেছে তাদের অবস্থাই সব থেকে শোচনীয়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে যারা ইংরেজি বর্ণ শেখা শুরু করছে, ছয় বছর বাদে, কলেজে গিয়ে তারা কি ভাবে সম্পূর্ণ ইংরেজিতে পড়াশুনো করবে? কলা বিভাগ যদি বাদ ও রাখা হয়, অবশ্য এতে ও অনেক বিষয় আছে যেগুলি ইংরেজিতে পড়তে হয় তবুও, বিজ্ঞান ও ব্যবসায়িক বিভাগে তো ইংরেজি জানা খুবই জরুরি। জাতীয় স্তরে সব বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইংরেজিতেই পড়াশুনো করানো হয়। তাহলে এই সব ছাত্রেরা কোথায় যাবে, তাদের কি ভাল জায়গায় বা দেশের ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়ার সুযোগ নেই? সব ছাত্রের মেধা সমান নয়, অনেকেই আছে যারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনো করেও এই সব বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনোর সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু যেকোনো লক্ষ্য তো সার্বিক হওয়া উচিৎ। এই ২২ বছরে পাশ করা ছাত্রছাত্রীরাই আজকের কর্মক্ষম যুবক-যুবতী, যাদের অনেককেই ইংরেজিতে একটা সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করতে বললে নিজেরই লজ্জা লাগবে।

এখন প্রশ্ন হল যে কোনটা ঠিক, ইংরেজি জানাটা ঠিক নাকি নিজের মাতৃভাষায় সড়গড় হওয়াটা ঠিক? আসলে আমাদের দেশে দুটোরই প্রয়োজন, কারণ একটা সরকারী ভাষা আর অপরটা মাতৃভাষা। আর প্রয়োজন দুটো ভাষাতেই কমবেশি সমান দক্ষতার। আমি দুটো ভাষাতেই সাহিত্য রচনার কথা বলছিনা, সেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্তত দুটো ভাষাতেই যেন কথা বলতে এবং ভাবপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়, সাথে নির্ভুলভাবে লিখতেও। অর্থাৎ, দুটো ভাষাতেই যেন যোগাযোগ করতে পারে। পড়াশুনো করতে হোক বা ভবিষ্যতে চাকরি করতে হোক, ইংরেজি ভাষা যখন অপরিহার্য তখন একে অবহেলা করার কোন মানে হয়না আর বিদেশী ভাষায় দক্ষ হতে গিয়ে নিজের মাতৃভাষাকে ভুলে যাওয়াটাও কোন বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়। 

পৃথিবীর নানান দেশে ভাষা শিক্ষা সম্পর্কিত যে সব গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে তার মাধ্যমে জানা যায় একটি শিশুর পক্ষে দুটি ভাষা একসঙ্গে শেখা যতটা সহজ, একটা পূর্ণবয়স্কর পক্ষে ততটাই কঠিন। গবেষকদের মতে ৩-৪ বছর বয়সে যদি সে তার মাতৃভাষা শেখা শুরু করে এবং ৬-৭ বছর বয়সে তার সাথে আরেকটা বিদেশী ভাষা যদি যোগ করা হয়, তাহলে তার পক্ষে স্বাচ্ছন্দে দুটো ভাষাতেই পারদর্শী হয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু এই বিষয়ে যেটা উল্লেখযোগ্য, সেটা হল যে প্রাথমিক শিক্ষা অবশ্যই তার মাতৃভাষা দিয়ে শুরু করা উচিৎ। বিদেশী যে কোনো ভাষা পরে এর সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। এখনকার স্কুলে ভর্তি হবার বয়সের অনুসারে ৬-৭ বছর, মানে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তারা যদি আরেকটা ভাষা শিখতে শুরু করে তাহলে পূর্ণবয়স্ক হবার সাথে সাথে তাদের দুটো ভাষাতেই সমান দক্ষতা এসে যাওয়া সম্ভব।

উপায়টা যতটা সহজ মনে হচ্ছে অতটা হয়তো নয়। এর জন্যে প্রয়োজন বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পূর্ণ নবীকরণ। একদিকে যেমন প্রয়োজন নতুন ভাবে পাঠ্যসূচী তৈরি করার তেমনই প্রয়োজন সেই পাঠ্যসূচী অনুসারে নতুন ভাবে পাঠ্য পুস্তকগুলিকে সাজানো।  কিন্তু সব থেকে বেশী জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষক নির্বাচন। কারণ এখানে এমন সব শিক্ষক প্রয়োজন যারা একই বিষয়, বাংলায় এবং ইংরেজিতে, সমান ভাবে পড়াতে পারবে এবং ক্লাসের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনাগুলিকেও দুটি ভাষার সমান দক্ষতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। শিক্ষক নির্বাচনের বিষয়টা চিরকাল রাজনৈতিকভাবে এমন একটা নাগপাশে বদ্ধ যে তার থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। সমকালীন সরকারের দায়িত্বে থাকা রাজনৈতিক দলগুলি তাদের সমর্থকদের প্রতি যে দুর্বলতা দেখিয়ে এসেছে তার ফল হাতে নাতে প্রমাণিত। কার্যকারিতা এবং যোগ্যতার বিচারের বাইরে শিক্ষক নির্বাচন যখন পার্টির সমর্থনতার ওপর নির্ভর করে তখন সেখানে একটা বড় খামতি রয়ে যায়। সবাই যে একরকম তা নয়, তবে বেশিরভাগটাই।

তবে সব থেকে বেশী প্রয়োজন হচ্ছে অভিভাবকদের মানসিক স্বচ্ছতা। বাচ্চারা স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়, তারা সেটাকেই সঠিক মনে করে যা অভিভাবকেরা তাদের শেখায়। এই পর্যায়ে যদি সে দ্যাখে যে তার মা-বাবা মাতৃভাষার বদলে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে তো স্বভাবতই তারাও সেটাই করবে। সেখানে উপকারিতার চেয়ে অপকারের মাত্রা বেশী হয়ে যাবে। বলা ভাল যে হয়ে গেছে। চারিদিকে এই খিচুড়ি ভাষার স্রোত দেখে এই উপলব্ধি খুবই স্বাভাবিক। একাধিক ভাষায় জ্ঞান থাকার মানে এই নয় যে একই বাক্যে সবকটা ভাষাই ব্যবহার করতে হবে বা একেকটা বাক্য একেক ভাষায়! স্বাচ্ছন্দ আমাদের অধিকার তবে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিন্নতা রক্ষা করাটাও আমাদেরই দায়িত্ব।

আজকাল দিকে দিকে ব্যাঙের ছাতার মত যে বেসরকারি স্কুলগুলো গজিয়ে উঠছে সেখানে শিক্ষার নামে ব্যবসা হচ্ছে। সরকারী স্কুলগুলোর থেকে এই স্কুলগুলোর পঠন-পাঠনরীতি একেবারে বিপরীত। নাই পাঠ্যসূচীর কোন ধারাবাহিকতা আছে না পাঠ্য পুস্তকের। কেন্দ্রীয় দুটি সংস্থার অন্তর্ভুক্তি যদিও কিন্তু পুরো বিষয়টায় বিস্তর গলদ। তবে একটা ব্যাপারে এরা অনেকটাই গণতান্ত্রিক – শিক্ষক চয়নে। বেসরকারি হওয়ায় প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা কম। এখানে বাচ্চারা মাতৃভাষার বদলে বিদেশী ভাষা আগে শেখে, এবং কোথাও কোথাও তো একাবারেই শেখে না, হিন্দি ভাষার প্রতি তাদের বেশী ঝোঁক। আর অভিভাবকেরা এই স্কুলগুলোকেই আদর্শ হিসেবে গণ্য করে, সোনার চাবিকাঠি পাবার শ্রেষ্ঠ উপায় তো এখানেই বলে দেওয়া হয়।।

পুনঃ গত ২৯এ জুলাই, কেন্দ্রীয় সরকার যে নতুন শিক্ষাব্যবস্থার ঘোষণা করেছেন তার বেশ কিছুদিন আগেই এই প্রবন্ধটি লেখা হয়ে যায়। নতুন যে সব সংযোজন বা পরিবর্তন ঘোষিত হয়েছে সে বিষয় আলোচনা এই লেখায় নেই।