ঘুণপোকা
সুব্রত দত্ত
ছুটির দিন। বিকেলে আলোক আর অঙ্কিতা তাদের ছোট্ট মেয়ে ঝিনুককে নিয়ে কাছেই নদীর ধারে বেড়াতে এসেছে। ঝিনুক তো নদীর ঢেউ দেখে খুব খুশি। ওর যত আবদার বাবার কাছে। বলে,
— “বাবা, কাগজের নৌকো বানিয়ে দাও না। আমি নদীতে ভাসিয়ে দেবো।”
— “আচ্ছা, এখানে আমি কাগজ কোথায় পাবো?”
— “না, আমাকে বানিয়ে দাও।”
— “আরে পাগলী মেয়ে, কাগজই তো নেই যে নৌকো বানাবো। তোমার তো কত্ত বুদ্ধি। এইটুকু বুঝবে না? আচ্ছা, এর পরে যেদিন আসবো, সেদিন অনেক কাগজ নিয়ে আসবো। মন খারাপ করো না, লক্ষ্মী মা আমার।
অঙ্কিতা বিরক্ত হয়ে বলে,
— “ঝিনুক, অমন করছো কেন? বাবা তো ঠিকই বলেছে। এখানে কাগজ পাওয়া যায়?”
আলোক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
— “আহা, বকছো কেন ওকে। বললাম তো পরের দিন নিয়ে আসবো। কি মা, তাই না?”
— “হুঁ, ঠিক আছে। আনবে তো পরের বার?”
— “হ্যাঁ রে মা, ঠিক আনবো। তবে আজ এক কাজ করলে কেমন হয়? আমরা যদি নদীর চরে গিয়ে বালি দিয়ে ঘর বানাই, তাহলে কেমন হয়?”
ঝিনুক আনন্দে নেচে ওঠে। বলে,
— “হ্যাঁ বাবা, চলো যাই। ও মা, চলো না।”
ওরা তিনজন নদীর চরে যায়। ঝিনুক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। ভেজা বালি দেখে আলোক প্রথমে একটা স্তুপ তৈরি করে। তারপর আঙ্গুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ঘরের দরজা, জানালা তৈরিতে মন দেয়। ঝিনুক অবাক হয়ে দেখে। বলে,
— “বাবা, তুমি কি সুন্দর ঘর তৈরি করতে পারো! এটা কি ঘর?”
— “এটা? উম, এটা হলো গিয়ে একটা খেলাঘর!
আলোক অঙ্কিতাকে বলে
— “এমন সুন্দর পরিবেশ! একটা গান শোনাও না গো। অনেকদিন হল তোমার গান শোনা হয় না।”
— “ধুস, এখানে কি গান গাইবো?”
— “কি গান? এই যে আমাদের আজকের খেলাঘর নিয়ে।”
অঙ্কিতা গান শুরু করে।
“খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে।
– – – – – – –
ভাঙারে জোড়া দেবে সে কিসের মন্তরে।”
নদীপাড়ের স্নিগ্ধ বাতাসে অঙ্কিতার সুরেলা কন্ঠের জাদুতে এক মোহময় আবেশে মগ্ন থাকে ওরা। আলোক আর ঝিনুক হাততালি দিয়ে ওঠে। এরমধ্যেই আলোকের বালির ঘর তৈরি শেষ। ঝিনুক বলে,
— “বাবা, পরের দিন এসে এই ঘরটাকে গাছ ফুল দিয়ে সাজাবো কেমন?”
আলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— “ততদিন কি আর এই খেলাঘর টিকে থাকবে? জোয়ারের ঢেউ এসে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।”
অঙ্কিতা তাড়া দেয়। বলে,
— “এবার ফেরা যাক। সন্ধ্যে হয়ে আসছে।”
ওরা হেঁটে ফিরছে। পাড়ায় ঢুকতেই দেখা হয়ে যায় মঞ্জরীর সাথে। অঙ্কিতার ওকে মোটেই সহ্য হয় না। অতিরিক্ত ঢলানি বলে। পূর্ব পরিচিত। পালিয়ে বিয়ে করেছিল। মঞ্জরী বলে,
— “কি ব্যাপার আলোকদা, ঘুরে এলেন বুঝি? কোথায় গিয়েছিলেন?”
আলোক বলে,
— “ঐ নদীর ধারে। ছুটির দিন তো!”
— “তো শুধু অঙ্কিতাদিকে নিলেই হবে? আমরা কি দোষ করলাম?”
— “না, দোষের কিছু নেই। গেলেই হয়!”
মঞ্জরী এসে আলোকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
— “ঠিক আছে, এর পরেরদিন কিন্তু সাথে যাবো।”
— “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
অঙ্কিতা একটা কথাও বলে না। বাড়িতে ফিরেই ঝিনুকের নালিশ,
— “জানো ঠাম্মি – দাদাই, বাবা কাগজের নৌকো বানিয়ে দেয় নি।”
— “তাই? ঠিক আছে খুব বকে দেবো।”
— “কাগজই তো ছিলো না। কি করে বানাবে?”
— “ও, তাহলে কি করলে?”
— “বাবা বালি দিয়ে একটা খেলাঘর ….. “
ঝিনুকের বকবকানির শেষ নেই। ওদিকে অন্য ঘরে গুমোট পরিবেশ। ঝড়ের পূর্বাভাস। আলোক নীরবতা ভেঙ্গে বলে,
— “কি হলো, তুমি চুপ করে আছো যে?”
— “তুমি জানো না কেন? ওর সাথে কথা বলতেই হবে?”
— “আরে বাবা, পাড়ার লোক, একটু কথা না বললে হয়?”
— “তাই বলে তোমার ঘাড়ে উঠতে হবে? তুমি তো কিছু বললে না! ওর সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে, তাই না? যাও, ওর সাথেই থাকো গে। তোমার মত ওর অনেক পুরুষ মানুষ আছে।”
— “ছিঃ অঙ্কিতা, এভাবে বলছো কেন? পাড়ায় থাকতে গেলে সবার সাথেই কথা বলতে হয়।”
— “জানি তো। আমাকে তোমার আর প্রয়োজন নেই। তাই তো বলি! কেন আমার সাথে বেশ কিছুদিন ধরে সেভাবে কথা বলো না।”
আলোক কিছুতেই বোঝাতে পারে না। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। অঙ্কিতা তাকে চরিত্রহীন ভাবছে? অকারণে! নিজের পক্ষে বলার মত ভাষাও আজ হারিয়ে ফেলেছে।
রাতে নিজের বালিশ নিয়ে অঙ্কিতা গেস্টরুমে চলে যায়। আলোক এরকম রাত কাটায় নি আগে কখনও। ক’দিন ধরে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় নি ওদের। আলোক বুকে ভীষন ভার বোধ করে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসেও কষ্ট হয়। ডাক ছেড়ে কাঁদতে পারলে হয়তো হালকা হতে পারতো। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। গম্ভীর হয়ে থাকে সারাক্ষণ। অবসাদ তাকে ঘিরে রয়েছে।
বাজার করে ফিরছে আলোক। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলো। প্রচন্ড বেগে একটা বাইক তাকে ধাক্কা মেরে চলে যায়। প্রচুর রক্ত বয়ে যায় রাস্তার ওপর। ভিড় জমে যায়। কেউ একজন বাড়িতে খবর দেয়।
হাসপাতালের পথেই সব শেষ।
অঙ্কিতা শোকে পাথর হয়ে গেছে। ঝিনুক বলে চলেছে,
— “মা, বাবা কখন আসবে? কাল তো রবিবার। বাবা আমাদের নিয়ে যাবে না খেলাঘর দেখাতে? ওটা এখনও ভাঙেনি। তাই না মা?”
অঙ্কিতা আজ উত্তর দেয়ার সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ওইটুকু অবুঝ শিশুকে সে কি বলে সান্ত্বনা দেবে, বুঝে পায় না। মেয়ে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে অঙ্কিতা।