সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টিতে বাবারা: আলোয়, অন্ধকারে
প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায়
সকলেই জানে ভারতবর্ষীয় বাবাদের মহিমা অপার। জন্মদাতার কথা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে যে বাবারা জন্মদাতার চেয়েও প্রণম্য হয়ে ওঠেন সন্তানদের কাছে, সেই বাবাদের কথাই বলছি। ভারতের চন্দ্রযান, মঙ্গলযান গন্তব্যে পৌঁছাতে পারল কিনা, তার ভিত্তিতে এ দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু জনমানসে বাবাদের প্রভাব আজও প্রশ্নাতীত। দূর বিদেশের জটিল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান থেকে শুরু করে কোরোনার ওষুধ আবিষ্কার পর্যন্ত কোন কিছুই এই বাবাদের অসাধ্য বলে মনে হয় না।
গুরুবাদী দেশ আমাদের। যে কোন ক্ষেত্রের সেরা মানুষটিকে সর্বগুণান্বিত বাবার স্তরে উন্নীত করতে না পারলে আমাদের আজন্ম শিষ্য মন মোটে শান্তি পায় না। মানুষটি যদি এমনিতেই রবীন্দ্রনাথ কি সত্যজিৎ রায়ের মত বহুমুখী প্রতিভার আধার হন, তাহলে তো কথাই নেই। যত্র তত্র রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করতে না পারলে, সত্যজিতের ছবি থেকে উদাহরণ দিতে না পারলে আমাদের সংস্কৃতিমনস্কতা নিজেই নিজেকে সন্দেহ করে। শ্বেতশুভ্র চুল দাড়ির রবীন্দ্রনাথকে তাঁর পদবি এবং বিশ্বভারতীর গুরুদেব হওয়ার কল্যাণে মানুষের বেশে ভগবান (নিন্দুক ইংরেজি ভাষায় — গডম্যান) বানাতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। সম্ভবত নিয়মিত দাড়ি গোঁফ কামানোর ফলে এবং কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত না হওয়ার কারণে সত্যজিৎ জীবদ্দশায় বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পর দুটো দশক না কাটতে তাঁরই অনুকরণে “জয় বাবা মানিকনাথ” কথাটা দিব্য চালু হয়ে গেছে।
গডম্যানরা ধরাধামে আসেন বাণী বিতরণের জন্য, ফলে যে মুহূর্তে কোন স্রষ্টাকে বাবা বানিয়ে দেওয়া হয় সেই মুহূর্তে তাঁর সৃষ্টিতে ডুব দেওয়া আর পুণ্য কর্মের মধ্যে পড়ে না, পূজার ছলে ভুলে থাকাই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এ দুর্দশা রবীন্দ্রনাথের হয়েছে, সত্যজিতেরই বা হতে কতক্ষণ? তাঁর মহানতর সৃষ্টি দৃশ্য শ্রাব্য মাধ্যমে হওয়ায় তিনি কিছুটা বেশি সময় পাচ্ছেন বড় জোর। সুতরাং এই বেলা দেখে নেওয়া ভাল বাবাদের সম্বন্ধে সত্যজিতের সৃষ্টিতে কী পাওয়া যায়। তাঁর ছবির চেয়ে বেশি জোর দেওয়া যাক তাঁর লেখায়। কারণ স্মার্টফোনের যুগে সিনেমা তবু দেখে ফেলা যায়, বই পড়তে যাবে কে?
দিনকাল বড় খারাপ। ইদানীং শিক্ষিত মহলেও আলোচনা হয় মাইকেল মধুসূদন খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছিলেন বলেই তাঁর কাব্যে রাবণ, মেঘনাদ প্রমুখ নায়ক। অতএব গোড়াতেই বলে রাখা ভাল যে সত্যজিৎ রায় ব্রাক্ষ্ম পরিবারের সন্তান বলেই তাঁর সৃষ্টিতে সাধু সন্ন্যাসী, জ্যোতিষ প্রমুখ ঠগ, জোচ্চোর — এমনটা বলা যাবে না। কারণ তাঁর লেখায় নানারকমের গডম্যানের দেখা পাওয়া যায়। ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ গল্পের মছলিবাবার মত নেহাত জেল পালানো দাগী আসামী যেমন আছে, তেমন উদাস বাবার (‘ডুমনিগড়ের মানুষখেকো’) মত লোকও আছেন, যিনি তুই তোকারির পাল্টা তুই তোকারি শুনেও রেগে যান না। উপরন্তু তারিণীখুড়োর কপালে মলম ঘষে দিয়ে বলেন “ব্যস, আর ভয় নেই তোর।“ অর্থাৎ মানুষখেকোর হাত থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়’ গল্পের প্রতিহিংসাপরায়ণ সাধু আছেন, আবার ‘এবার কাণ্ড কেদারনাথে’ গল্পের ভবানী উপাধ্যায় আছেন। তিনি আসলে লালমোহনবাবুর কাকা দুর্গামোহন গঙ্গোপাধ্যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, পুরোপুরি সন্ন্যাসের পথে চলে যাওয়ার আগে অপরিচয়ের জীবন কাটাচ্ছিলেন নিঃস্বার্থভাবে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করে। বস্তুত, যদি ধরে নেওয়া যায় স্রষ্টাকে সত্যিই তাঁর সৃষ্টিতে খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে বলতে হবে সত্যজিতের বিজ্ঞানমনস্কতা যেমন ছিল, তেমন বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা হয় না তাকেই আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়ার লোকও তিনি ছিলেন না। ফলে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করে যারা, বা ধর্মই আগাগোড়া ধারণ করে আছে যাদের, তাদের সম্বন্ধে কোন অতি সরলীকরণ কখনোই তাঁর লেখায় পাওয়া যায় না।
সেই কারণে অলৌকিকতা বা সাধুদের সম্বন্ধে সত্যজিতের চরিত্ররাও সকলে এক সুরে কথা বলে না। শঙ্কু এক জায়গায় তাঁর ডায়রিতে লিখছেন “সাধু-সন্ন্যাসীদের সম্পর্কে আমার ভক্তির একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। এদের মধ্যে বুজরুকের সংখ্যাই যে বেশি তার প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি।“ আবার তারিণীখুড়ো এক জাদুকরের নির্দেশে তাঁর গুরুর বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কঙ্কালকে গড় করছেন। জাদুকর জিজ্ঞেস করছেন “যা করছ তা বিশ্বাস করে করছ তো?” উত্তরে খুড়ো বলছেন “আমার মনের সব কপাট খোলা, ভোজরাজজী। আমি হাঁচি টিকটিকি ভূত-প্রেত দত্যি-দানা বেদ-বেদান্ত আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি” (তারিণীখুড়ো ও বেতাল)।
সত্যজিতের লেখায় পাওয়া বাবাদের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় বোধহয় ‘খগম’ গল্পের ইমলিবাবা। তিনি মোটেই উদাস বাবার মত নিরীহ নন, বরং গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে লেখা হয়েছে “কার কথা মনে পড়ছে বাবাকে দেখে? ছেলেবেলায় দেখা বীডন স্ট্রীটে আমার মামাবাড়ির দেয়ালে টাঙানো রবিবর্মার আঁকা একটা ছবি। দুর্বাসা মুনি অভিশাপ দিচ্ছেন শকুন্তলাকে। ঠিক এইভাবে হাত তোলা, চোখে ঠিক এই চাহনি।” এই বহুপঠিত গল্পের চরিত্র ধূর্জটিবাবু দেশে কুসংস্কারের বাড়বাড়ন্ত সম্বন্ধে যা বলেন, কোন বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষ তার সাথে ভিন্নমত হবেন না। অথচ গল্প যে ভাবে বলা হয়েছে তাতে ইমলিবাবাকে খলনায়ক ভেবে নেওয়া কিন্তু বেশ শক্ত হয়। বরং গল্পটা যতবার পড়ি, অকারণে প্রাণী হত্যা করার জন্য ধূর্জটিবাবুর উপরেই যেন রাগ হয় বেশি।
স্পষ্টতই সত্যজিৎ অলৌকিক ক্ষমতার অস্তিত্বকে বা সাধু সন্ন্যাসীদের তেমন ক্ষমতা থাকার সম্ভাবনাকে কোথাও নস্যাৎ করছেন না এইসব গল্পে। অলৌকিক বলে কিছু হয় না — এমন মন্তব্য ফেলুদার কাহিনীতেও করেন না। ‘সোনার কেল্লা’ ছবির বিখ্যাত শেষ দৃশ্যে ফেলুদা পরাভূত ভবানন্দকে বলে “আপনি মিথ্যে এত মেহনত করলেন মিস্টার ভবানন্দ। কারণ গুপ্তধন নেই। পূর্ব জন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই।” কিন্তু বাবাজিদের বেলায়, ভবিষ্যদ্বক্তাদের বেলায় ফেলুদার গল্পে এই ফাঁকটুকু রাখা হয়নি। ‘হত্যাপুরী’ গল্পের লক্ষ্মণ ভট্টাচার্য কেবল বুজরুক নয়, সে চোর এবং খুনী। ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ গল্পের মৃগেন ভটচায, যে মানুষের শ্রদ্ধা আদায় করে আত্মারাম হয়ে বসেছে, সেও অপরাধী। ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ গল্পের খুনী শশধর বোস সর্বজ্ঞ, প্ল্যানচেট করার ক্ষমতাধারী হওয়ার ভেক ধরে। স্মর্তব্য যে ‘সোনার কেল্লা’ র মূল খলনায়কটিও একদা এলাহাবাদে ভবানন্দ সেজে ব্যবসা জমিয়েছিল। ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ গল্পের মছলিবাবা এদের কাছে নেহাত শিশু। সে চোরা কারবারির ক্রীড়নক মাত্র।
অন্য গল্পে লৌকিক-অলৌকিকের বিভাজনে উদার, বাবাজিদের সম্বন্ধে নমনীয় সত্যজিৎ গোয়েন্দা কাহিনীতে এত কঠোর হলেন কেন? আসলে বিভাজনটা রহস্যোপন্যাস আর অন্য গল্পের নয়। ব্যতিক্রমহীনভাবে লোকালয়ের বাইরে থাকা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীরা ভাল মন্দ যা-ই হোন, কিছু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। বিলাস ব্যসনে থাকা, প্রভাবশালী ভক্ত পরিবৃত বাবাজি এবং তাদৃশ লোকেরা সত্যজিতের কলমে বিশেষ কোন ক্ষমতারহিত “দুষ্টু লোক”। ‘নিতাই ও মহাপুরুষ’ গল্পের জীবানন্দ তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। লেখক তাকে পিঠটান দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন অবশ্য। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৯৩ সংখ্যায় প্রকাশিত এই গল্প গড ম্যানদের সম্বন্ধে সত্যজিতের মতামতের এই তারতম্য বুঝতে বিশেষ সাহায্য করতে পারে।
লক্ষণীয়, শিরোনামে মহাপুরুষ শব্দটা আছে সত্যজিতের এমন সৃষ্টি মাত্র দুটো। একটা দৃষ্টান্ত উপর্যুক্ত গল্পটা। অন্যটা ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’। রাজশেখর বসুর গল্প ‘বিরিঞ্চিবাবা’ অবলম্বনে তৈরি ‘মহাপুরুষ’ অংশের সঙ্গে ‘নিতাই ও মহাপুরুষ’ গল্পের পটভূমিকার সাদৃশ্য সামান্য নয়।
বিরিঞ্চিবাবা আসর জমিয়েছিলেন আলিপুরের ধনী উকিল গুরুপদবাবুর বাড়িতে, জীবানন্দ হ্যারিংটন স্ট্রিটের ব্যারিস্টার যতীশ সেনগুপ্তের বাড়িতে।
বিরিঞ্চিবাবা ত্রিকালজ্ঞ, পুরাণ থেকে থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি — সব তাঁর হাতের মুঠোয়। আর জীবানন্দ সম্পর্কে সত্যজিৎ লিখছেন “যিনি বাগ্মী, যিনি সুকণ্ঠ, যাঁর গীতার ব্যাখ্যা শুনে লোকে মোহিত হয়ে যায়, যাঁর চরণস্পর্শ করতে পারলে লোকে কৃতার্থ বোধ করে। ঈশ্বরের এক ধাপ নীচেই তাঁর স্থান।”
রসরাজের গল্পটা না পড়ে থাকলেও যাঁরা সত্যজিতের ছবিটা দেখেছেন তাঁদের স্মরণ থাকবে শহরের প্রভাবশালী শিষ্যদের দাপটে বিরিঞ্চিবাবার কাছে পৌঁছানোই বেশ কঠিন। সেখানে প্রবেশ করতে বাবার মুরুব্বি গণেশমামার দ্বারস্থ হয় নিবারণ, সত্যব্রত, পরমার্থ। এবং নিতাই নামে একটি চরিত্র। সত্যজিতের গল্পের নিতাই জীবানন্দ সম্বন্ধে বলছে “তাঁর একশো হাতের মধ্যে তো যাওয়া যায় না বলেই শুনেছি।” এই গল্পে নিতাইয়ের সহায় হয় তার ভায়রাভাই রসিকলাল, যে গদগদ হয়ে বলে “সবাই পারে না যেতে, কিন্তু আমি কী কপাল করে এসেছি জানি না — আমার স্থান একেবারে প্রথম সারিতে। কথা যখন বলেন তখন বেশিরভাগটাই আমার দিকে চেয়ে বলেন। শুনে গায়ে কাঁটা দেয় বারবার।”
আসলে বিরিঞ্চিবাবার সমগোত্রীয়রাই লেখক সত্যজিতের আক্রমণের লক্ষ্য। যে বছর ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ মুক্তি পায়, সে বছরই ফেলুদার গল্প লিখতে শুরু করেন সত্যজিৎ। পরবর্তী তিন দশকে বারবার নানা চেহারার বিরিঞ্চিবাবারা ফেলুদার হাতে নাস্তানাবুদ হয়।
সুললিত ইংরেজি বলে বা যোগাসনের ভেল্কি দেখিয়ে জনপ্রিয়, ক্ষমতার ভাগ পাওয়া কোটিপতি বাবাদের যুগে বারবার মনে পড়ে যায় ‘মহাপুরুষ’ ছবিতে নিবারণের সংলাপ “অতি উচ্চ শ্রেণীর অভিনেতা। মাস সাইকোলজি বোঝে। পড়াশোনা আছে। আশ্চর্য স্মরণশক্তি আছে। ইম্যাজিনেশন আছে। উপস্থিত বুদ্ধি আছে। গাটস আছে। আর কী চাই? বলতে পারিস অনেস্টি নেই। সে তো আজকাল অনেক সো কল্ড মহারথীদেরও নেই। কিন্তু… ওকে… এক্সপোজ করতে হবে। কারণ… ও এক্সপোজ না হলে এরাও হবে না। যারা ওর পায়ে গিয়ে ধরনা দিচ্ছে, ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, ওকে বাড়তে দিচ্ছে।”
মনে রাখা ভাল, বিরিঞ্চিবাবাকে এক্সপোজ করার এই যুক্তি কিন্তু রাজশেখর বসুর গল্পে নেই, পরিচালক সত্যজিতের চিত্রনাট্যে এসেছে। এরপর থেকে নিজের লেখায় সত্যজিৎ বারবার এই এক্সপোজ করার কাজটাই করেছেন। তাঁর শতবর্ষে আমরা কি এক্সপোজ করার শিক্ষাটা নেব? নাকি বাবাজিদের হাতে ইহকাল পরকালের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হব?
তথ্যসূত্রঃ
১। ফেলুদা সমগ্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯
২। সেরা সত্যজিৎ, আনন্দ পাবলিশার্স, তৃতীয় মুদ্রণ, এপ্রিল ১৯৯২
৩। গল্প ১০১, আনন্দ পাবলিশার্স, তৃতীয় মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০২
৫। পরশুরাম গল্পসমগ্র, এম সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, নতুন সংস্করণ, শ্রাবণ ১৪১৫ আগস্ট ২০১৮